জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[তেতাল্লিশ]
বাবার শরীর খারাপের জন্যে এই বছর সনাতনরা আর কোলকাতায় হৃদারাম ব্যানার্জী লেনের দূর্গাপূজায় ঢাক বাজাতে যাবে না। দিঘিরপাড় বাজারে পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে একটু আগে আগেই সন্তোষবাবুকে ফোনে জানিয়ে দেয়। সনাতন এবং সন্তোষবাবু দু’তরফেরই এই সংবাদে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি যদি প্রতিকুল হয় তখন কারোর কিছু করার থাকে না। সেটা মেনে নিয়ে সন্তোষবাবু সনাতনকে বলল, যদি তার জানাশোনা ভাল কোন ঢোলের দল পাঠাতে পারে তো ভাল হয়। ঢাক যেহেতু সনাতন-রতনরা বাজায়, সেই বাজনা তাদের কানে লেগে আছে। এর পর অন্য কারোর বাজনা ভালো লাগবে না। মন খারাপ হয়ে যাবে। তাই সন্তোষবাবু ঢোলের দল পাঠাবার প্রস্তাব দেয়। একবাক্যে সনাতন রাজি হয়ে যায় এবং তাদের উভয় পক্ষের যাতে মানসম্মান বজায় থাকে তেমন একটা দলকে সে পাঠাবে কথা দেয় সন্তোষবাবুকে। সনাতনের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে সন্তোষবাবু বলে, “এই জন্যেই সনাতন তোমাকে আমরা এতটা ভরসা করি। জানি, একটা সুব্যবস্থা তুমি করবেই।”
তাজপুরের পাইক-পাড়ার তিমির পাইক সুবোধ কাকার বাড়ি কয়েকদিন ধরে যাতায়াত করছে, সনাতন দেখেছে। মনে হয় ঢোলের অর্ডার দিয়েছে সুবোধ কাকার কাছে। ঢোল তৈরীর পাকা মিস্ত্রী এই সুবোধ কাকা। ঢাক বানাতেও ওস্তাদ। কিন্তু রুইদাস পাড়ার বেশিরভাগ ঢাকি নিজেরাই নিজেদের ঢাক বানিয়ে নেয়। টুকটাক অসুবিধা হলে পাড়ার পাকা কারিগর যারা আছে তাদের সাহায্য নেয়। তাই ঢাকের অর্ডার বেশি পায় না। পাড়ার কয়েকজনই আছে যারা ঢাক- ঢোলের অর্ডার বাইরে থেকে পায়। সুবোধ কাকা তাদের মধ্যে অন্যতম। আর সময় নষ্ট না করে সুবোধ কাকার বাড়ি গেল সনাতন। পিপার মত একটা কাঠের খোলের এক মুখে গরুর চামড়া লাগাচ্ছিল কাকা। আর এক মুখ ছাগলের চামড়া দিয়ে তার আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়ে গেছে। সনাতন গিয়েই কাকাকে ডিস্টার্ব করতে চাইল না। কাকা পেছন ফিরে কাজ করছিল বলে তাকে দেখতে পায়নি। এক মনে কাজ করে চলেছে বুড়ো। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা টুলে বসে কাকার হাতের যাদু পরখ করে চলেছে। সনাতন জানে এর পর ঢোলের খোলের দু’মুখ মাঞ্জা দেওয়া মোটা সূতোর দড়ি বা নাইলন দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার ভেতর ছোট্ট আকারের পিতলের বালা পরাতে হবে। হিসেব করে বাঁধা দড়ি এই বালার মাধ্যমে টান করে বা আল্গা করে ঢোলের সুর বাঁধা হয়। কাজের ঝোঁকে এবার এদিকে ঘুরতে সনাতনকে দেখতে পায় সুবোধ কাকা। অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে,“আরে, আমার সনাতন বেটা যে। খবর কি রে বাবা? হঠাৎ কি মনে করে আমার বাড়ি? তুই তো বাবা খুব কাজের ছেলে। এমনি এমনি আমার বাড়ি আসতে পারবি না। নিশ্চয়ই কোন কাজে এসেছিস। বল বাবা বল। কি দরকার। কখন এসে চুপচাপ বসে আছিস। সাড়াই করিসনি। আমি আমার মত কাজে ডুবে আছি।”
-ঠিক আছে কাকা। তাতে কি। এক মনে কাজ করছো। হাতের কাজটা না সেরে বা তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে কেমন করে। কাজের তাল কেটে যাবে। তাই আর ডাকাডাকি করিনি। যে জন্যে এসেছি, কাকা। ওই তিমির পাইক তোমার কাছে আসে দেখেছি। নিশ্চয়ই কাজের অর্ডার দিয়েছে। না হলে আর সেই তাজপুর থেকে এতটা পথ উজিয়ে আসতে যাবে কেন। ও আবার কবে আসবে কাকা? ওর সঙ্গে আমার দরকার আছে। কোলকাতায় আমাদের দূর্গা পূজার অর্ডারটা ওকে দেব ভাবছি। জানো তো বাবার শরীর খারাপ। বাবাকে নিয়ে কোলকাতায় কাজে যাওয়া যাবে না। তা ভাবলাম তিমির পাইক মানুষটা, ভাল-মানুষ বলে পরিচিতি আছে। কোলকাতার ওরা তেমনই একজনকে পাঠাতে বলেছে। যদি ওরা রাজি হয় তাহলে যাবার কথা বলবো। তোমার কি মত কাকা?” পরামর্শ চাওয়ার মত করে সনাতন বলল।
-হ্যাঁ। এটা ঠিক। তুমি যা শুনেছো ঠিক শুনেছো। তিমির পাইকের ঢোলের দলের সুনাম আছে। যেমন ভাল বাজায় তেমন আচার ব্যবহারও লোকের মন কেড়ে নেবার মত। তা তুমি বিকেলের দিকে একবার ঘুরতে ঘুরতে এদিকে এসো-না। ওর আসার কথা আছে। তিনটে ঢোলের অর্ডার দিয়েছে। একটা হয়ে গেছে। সেটা নিতে আসবে। ও আমার লক্ষ্মী খদ্দের। মাল ডেলিভারী নেবার সাথে সাথে ফুল পেমেন্ট করে দেয়। কিছু আগামও দিয়ে দেয়। আমি চেয়ে নিই। আমার তো আর এইসব ঢোলের খোলের কাঠ কেনার মত অত বেশি পয়সা নেই। তাই আগাম না নিলে চলে না। তা, ওরা সেটা ‘না’ করে না। দিয়ে দেয়। তুষ্ট মনে সুবোধ কাকা বলল।
সনাতন দেখলো হ্যাঁ, কাকা ঠিক কথাই বলেছে। আরও দুটো ঢোলের খোল ঘরে পড়ে আছে। কাকারা সাধারণত নিম বা কাঁঠাল কাঠের গোড়ে থেকে এই খোল বানিয়ে থাকে। অন্য কাঠেও সম্ভব। তবে আমাদের এখানে এই কাঠ বেশি পাওয়া যায় বলে ব্যবহার করা হয়। তাতে কাঠ বাবদ খরচটা অনেক কম হয়। এই যেমন মৃদঙ্গ-খোল তৈরীর জন্যে এগুলো ছাড়াও রক্ত চন্দন বা খয়ের কাঠ হলে খুবই ভাল হয়। সেই কাঠ আমাদের এদিকে কোথায়! অনেক খরচা তা জোগাড় করতে। পোষাবে কেন! একটা মোটা কাঠের গোড়ে মাঝ বরাবর চিরে নিয়ে তার ভেতরের শাঁস-অংশ কেটে বা চেঁচে ফেলে দিলে ভেতরটা
ফাঁপা হয়ে যায়। দুটো অংশ এইভাবে ফাঁপা করে আঠা দিয়ে জুড়ে দিলে পূর্ণ একটা খোল তৈরী হয়ে যায়। এবার খোলের দু’প্রান্ত খানিকটা করে কেটে সরু মত করে দিতে হয়। তাহলে খোলের দু’মুখের তুলনায় মাঝবরাবর পেটের অংশ মোটা হয়ে গেল। একটা পূর্ণ ঢোলের চেহারা পেয়ে গেল। এবার সেটাকে মেজে ঘষে মসৃণ করে তার উপর সৌন্দার্যয়ণ করা হয়। এ’দুটোয় ওইগুলো সব এখন বাকি আছে। তার মানে তিমির পাইককে আরও কয়েকবার সুবোধ কাকার কাছে আসতে হবে। কাকার কথামত বিকেলের দিকে আসবে বলে সনাতন তখনকার মত চলে যাবার সময় বলে গেল,“কাকা, এখন আমার পড়ানো আছে। ছাত্রীরা এসে পড়বে। বিকেলে সময় মত আমি এসে যাব। আমি বাড়ি থেকে খেয়াল রাখব তিমির পাইক কখন তোমার বাড়ি আসছে। দেখতে পেলেই অমনি ছুটে চলে আসব।”
বিকেলের ব্যাচটা পুরোপুরি তাদের পাড়ার ছেলেমেয়েদের জন্যে রেখেছে সনাতন। এরা সব গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। বেশি পয়সা দিতে পারবে না। তাই অন্য ব্যাচের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে টিউশনির ফীস নিয়ে পাড়ার ছাত্র আর বাইরের ছাত্রদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। পয়সার অভাবে ইচ্ছুক পাড়ার ছাত্রদের লেখাপড়া হবে না তা সনাতন কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। এটা তার নীতি নয়। হয়তো সংসারে পয়সার প্রয়োজনেই সে টিউশনি বেশি করে করছে সেটা ঠিক। সেইসঙ্গে সমাজ সংস্কারের একটা বোধ তার মনে সবসময় কাজ করে। সেই সংস্কার-কাজ চালাতে গেলে এই সমস্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ঢোকানো প্রয়োজন। ওদের পাড়ার ছেলেমেয়েদের বেশিদূর লেখাপড়া না হওয়ার কারণ একাধিক। উপযুক্ত গাইড না পাবার কারণে অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে শুধুমাত্র প্রতিযোগিতায় তারা পেরে ওঠে না তা নয়। পরীক্ষায় মোটেই ভাল ফল করতে পারে না। বড় হবার সাথে সাথে তাদের মধ্যে মান-অপমান বোধ জন্মে যায়। পড়া না-পারার গ্লানি তাদের মনের মধ্যে কাজ করে। অচিরেই তারা পড়া ছেড়ে দিয়ে রাখাল হয়ে গরু চরানোকে নিজের কাজ বলে মেনে নেয়। এটা যেন তাদের সম্প্রদায়ের একটা চিরাচরিত অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই শাপমোচন করার লক্ষ্যে তার এই ক্ষুদ্রতম প্রচেষ্টা। যার পরিবারের যেমন সামর্থ তারা তেমন পয়সা দিল, যাদের নেই তারা দিল না। তাতে তার বিন্দুমাত্র আপসোস নেই। কিন্তু একটাই তার কড়া অনুশাসন, মন দিয়ে লেখাপড়া তাদের করতে হবে। নাহলে নির্বিচারে দানসত্র খোলার অভিপ্রায় তার বিন্দুমাত্র নেই।
ন’ক্লাস থেকে বারো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের পড়ায় সনাতন। বিকেলের ব্যাচের ছেলেরা সকলেই নাইনে পড়ে। সমাজবিজ্ঞানের একটা প্রজেক্ট করতে দিয়েছে স্কুল থেকে। সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময় সানাতন ছাত্রদের বলল,“আমি আজ তোমাদের প্রোজেক্টের মোটামুটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেব। তারপর সেই বিষয়টার ডিটেলস্ নোটস্ লিখে দেব। সেটা দেখে নিজের মত করে তোমরা ভাবনাচিন্তা করে প্রোজেক্টটা করে আমাকে দেখিয়ে তারপর স্কুলে জমা দেবে। আমি প্রস্তাব দেব, আমাদের মুচি-রুইদাসদের নিয়ে তোমরা কাজ করো। যেহেতু আমাদের এই জাতটা সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর এবং সবদিক থেকে পেছিয়ে পড়া জাত। সেটা একটা প্রোজেক্টের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারলে ভালো নাম্বার পাওয়া যেতে পারে।”
সনাতন স্যারের কথার প্রেক্ষিতে সন্তোষ বলে ছাত্রটা বলল, “স্যার ক্লাসে অমর স্যার প্রোজেক্টের যে ধারণা দিয়েছিল তাতে বলেছিল, সমাজের দুর্নীতি বা মানবিক অবক্ষয় এইসব বিষয় নিয়ে প্রোজেক্টের ভাবনাটা রাখতে। সেখানে এই বিষয়টা একদম আলাদা। অমর স্যার এটা মেনে নেবে তো স্যার? আমরাই আবার আমাদের নিয়ে লিখছি। নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটাচ্ছি। তেমন ভাববে না তো কেউ?”
সন্তোষের প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে সনাতন বলল,“কথায় আছে না, “আপনা হাত জগন্নাথ” সেইরকম। আমাদের কথা সমাজের কাছে আমাদেরই তুলে ধরতে হবে। অন্য কেউ ভালোবেসে আমাদের কথা বলতে আসবে না। আমাদের সম্প্রদায় তো শুধু এই বয়ারিয়া গ্রামের রুইদাস পাড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তামাম ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই মুচি সম্প্রদায়। সে’কথা ক’জন জানে? কোন প্রোজেক্টের কাজ একটা থিসিস লেখার মত প্রায়। এর মাধ্যমে অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরা যায়। সেইজন্যেই তো এই ‘প্রোজেক্ট বিষয়টা’ সিলেবাসের মধ্যে নিয়ে আসা। অমর স্যার যেটা তোমাদের বলেছে, সেটাই তো আমি তোমাদের বলতে চাইছি। তোমরা কি জানো? আমাদের এই মুচি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি কোথা থেকে? জানো না। এখানকার বয়স্ক মানুষদেরও মনে হয় জানা নেই। শোনা যায় মুচি শব্দটা এসেছে মোজা থেকে। গুজরাটের ‘পাভগাধে’র মানুষ বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন জন্তুর চামড়া থেকে মোজা তৈরী করত। সেই থেকে মুচি নামটা, মুচি জাতে পরিণত হয়। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের মুচিরা আবার দাবি করে তারা মূলত রাজস্থানী। তাদের পেশা ছিল সৈন্যদের জন্যে চামড়ার মোজা, পোষাক তৈরী করা। তারা রাজপুত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এই দুই মতের মধ্যে ‘মোজা’ কথাটায় মিল পাওয়া যায়। অতএব এই মোজা শব্দ থেকে মুচি নামটার একটা বিশ্বাসযোগ্য ভাবনা থাকতে পারে। সেটা আমরা ধরেও নিতে পারি।” সনাতন স্যারের কথায় বিস্ময় প্রকাশ করে বিজয় বলল,“এ তো স্যার বেশ অবাক করা কথা ! আমাদের তো এটা জানাই ছিল না। অথচ তা আমাদের সকলের জানা দরকার।” বিজয়ের কথা শেষ হতেই অমল বলল, “স্যার, আপনি যে বললেন না, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আমরা অবস্থান করছি। মোটামুটি কোথায় কোথায় আমরা আছি একটু বলবেন?” উত্তরে সনাতন বলল, “নিশ্চয়ই বলব। ভারতবর্ষের মধ্যে বিশেষ করে উত্তর ভারতে আমাদের সম্প্রদায়ের বাস বেশি। যেমন ধরো, উত্তর প্রদেশের সীতাপুর, এলাহবাদ, সুলতানপুর, ফরিদাবাদ, গন্ডা, কানপুর আর লক্ষনৌ জেলায় সবচেয়ে বেশি মুচিদের বাস। তারপর পাঞ্জাব, মহারাষ্টু, গুজরাট, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশের, কৃষ্ণা, গুন্টুর, পূর্ব গোদাবরি, হায়দ্রাবাদ, কুর্নুল, আদিলাবাদ জেলায়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, মালদা, মুর্শিদাবাদ জেলা ছাড়াও আরও কিছু কিছু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর বিহার, মধ্যপ্রদেশে তো বহু চামার সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। এই চামারদের সাব-কাস্ট হিসেবে মুচিদের ধরা হয়। শোন, যতটা আমার স্মরণে আছে মুখে সেটুকুই বলছি তোমাদের। নোটস যেটা দেব সেটাতে আরও বিস্তারিত লেখা থাকবে। মুখে একটু বুঝিয়ে দেবার পর নোটসটা পড়ে নিলে প্রজেক্টটা তৈরী করতে সুবিধা হবে। তবে কেউ কিন্তু কারোর দেখে বা হুবহু নকল করবে না। তাহলে সব্বাইয়ের প্রোজেক্ট বাতিল হয়ে যেতে পারে। অমর স্যার ঠিক ধরে ফেলবে। আমাদের ব্যাপারটা অমর স্যার অনেকটাই জানে। আমাকে খুব ভাল করে চেনে। অমর স্যার, আমারও স্যার। এই তথ্যগুলো নিয়ে নিজেদের স্বাধীন ভাবনায় লিখবে। বৈচিত্র্যের মধ্যেই সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।” চঞ্চল ছেলেটা এতক্ষণ পরে বলল,“স্যার আমরা তো বাংলায় কথা বলি। মানে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। তা মুচিদের নিজস্ব কোন ভাষা আছে নাকি ? এই যেমন সাঁওতালরা সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে। উত্তরবঙ্গের কামতাদের ভাষা হোল কামতাপুরি। সেইরকম আরকি।” চঞ্চলের প্রশ্নটা যে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত এবং সঠিক তা মেনে নিয়ে সনাতন বলল, “তুই একটা দারুণ প্রশ্ন করেছিস, চঞ্চল। সাঁওতাল, কামতাপুরী বা এমনতর আরও অন্যান্য সম্প্রদায়ের যদি নিজস্ব ভাষা থাকতে পারে তাহলে মুচি-চামারদেরও তো তা থাকা অস্বভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তাহলে তো আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রয়াস চালিয়ে যেতাম। যেমন অন্যরা করছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা যে অঞ্চলে বসবাস করি সেই অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাকেই নিজেদের ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি সে ভাবনা করতো তাহলে হয়তো তা হতে পারতো। কিন্তু তা না হবার যে অপরিহার্য কারণ, সেটা হল আমাদের মানুষগুলো চিরকালই অত্যন্ত অভাব এবং অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটিয়ে এসেছে। তারা নিজেদের পেটের চিন্তা করবে না ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করবে। এই আমাদের রুইদাস পাড়ার দিকে তোরা তাকা-না। ক’টা লোক লেখাপড়া জানে দেখ। এখন দু’চারজন, তোদের আমাদের মত আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় এগিয়ে এসেছে। তাই আমরা এইসব ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছি। সেইসময়কার মানুষের যদি উদয় অস্ত পেটের চিন্তা না করতে হত তাদের ভাবনা চিন্তা অন্য খাতে বওয়ার ফুরসত থাকতো। তারা লেখাপড়ার কথা, ভাষা-সংস্কৃতির কথা ভাবতে পারতো। যাক। যেটা বলছিলাম। সেটা ভেবে এখন আর লাভ নেই। এখন ভাবলেও আমরা আমাদের আপন ভাষা তৈরী করতে পারব না। বাস্তবসম্মতও নয়। এখন উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে যারা বাস করে তারা কথা বলে হিন্দি এবং দেবনাগরী ভাষায় লেখে। আসামের ভাষা আসামী, গুজরাটে গুজরাটি, মহারাষ্ট্রে মারাঠি, অন্ধ্রে তেলেগু, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবী, বিহারে ভোজপুরী, কর্ণটকে কানাড়া, উড়িষ্যা ওড়িয়া। এখানে একটা ব্যাপার দেখ, আমরা একই জাত-সম্প্রদায়ের হয়েও পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। তার একটাই কারণ, ভাষার বিভিন্নতা। আমরা বাংলাভাষীরা কি মারাঠী ভাষীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারব? পারব না। বরং তাদের ভাষা না বুঝতে পেরে তাদের থেকে দূরে সরে আসব। যেটা সারা ভারতবর্ষের সাঁওতাল বা কামতাপুরী বা অন্য অন্তজ শ্রেণীর মানুষ যারা নিজস্ব ভাষার অধিকারী, তাদের ক্ষেত্রে সেই অসুবিধা নেই।”
তাদের সনাতন স্যার নিজেদের জাতের ব্যাপারে এতকিছু জানে জেনে এই চার ছাত্রই অবাক হয়ে যায়! অথচ বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না। কত জ্ঞান এনার। এর কাছে পড়তে না এলে তারা এই স্যারের ব্যাপারে কিছুই জানতো না। স্যারের কাছে যত পড়ছে ততই এনার সম্বদ্ধে তাদের ধারণা বদলে যাচ্ছে। বিস্ময়ের সঙ্গেই চঞ্চল আবার জিজ্ঞেস করল, “স্যার আপনি এতকিছু জানলেন কেমন করে? এর আগে কেউ তো আমাদের নিজেদের জাতের ইতিহাস এমন করে বলেনি। এমনকি আমার বাবা-দাদুরাও না।” এবার ছাত্রদের আশ্বস্ত করার জন্যে সনাতন বলল, “দেখ, আমাদের বাবা- দাদুরা লেখাপড়া শিখেছে? শেখেনি। এগুলো জানতে গেলে তো পড়াশোনা করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে হবে। সবার উপর জানার উদগ্র চেষ্টা বা ইচ্ছা থাকতে হবে। তোরা এখন পড়াশোনা করছিস বলে এতকিছু জানতে পারছিস। এই আমাদের পাড়ায় তোদের বয়সী আরও কত ছেলেমেয়ে তো আছে। ছেলেরা তো বাউন্ডুলের মতো ঘুরছে, মদ খেয়ে মাতলামী করছে। তারা বড় হয়ে সন্তানদের কি শেখাবে! ভেবে দেখেছিস একবারও! সেইজন্যে বলছি লেখাপড়ার কোন বিকল্প নেই রে। এবার আরও দু-একটা পয়েন্টস বলে আজকের মত ছুটি দিয়ে দেব। আগেও বলেছি, তারপর ডিটেলসটা নোটসে পড়ে নিস। এই আমরা মুচিরা তো হিন্দুধর্ম পালন করি। মানে আমরা হিন্দু। এই মুচিরা আবার মুসলমান, শিখ ধর্মালম্বীও আছে কিন্তু। পাঞ্জাবে যেমন হিন্দু মুচি আছে তেমনি শিখ মুচিও আছে। পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, কাশ্মীরে মুসলমান মুচি প্রচুর আছে। এরা মূলত হিন্দু ছিল একসময়। কিন্তু বিভিন্ন সময় শাসকশ্রেণীরা নিজেদের স্বার্থে বলপূর্বক তাদের মুসলিম বানিয়ে দেয়। পাঞ্জাবের হিন্দুরা আবার শিখ হয়েছে স্বেচ্ছায় । আর একটা কথা জানাই। এটা জানা বিশেষ দরকার। অন্ধ্রপ্রদেশে মুচিদের মধ্যে পঁয়ষট্টি ভাগ মুচি হিন্দু। তবে তারা সন্ত রবিদাসকে অবতার হিসেবে মানে। ইনি একজন চর্মকার ছিলেন। অন্ধ্রে নিমিশাম্বা দেবীকে আরাধ্যা দেবী হিসেবে মানে। আজ এই পর্যন্ত। এবার তোরা বাড়ি যা। আবার একটু পরে, পরের ব্যাচ আসবে। তার আগে আমাকে একবার সুবোধ কাকার বাড়ি যেতে হবে। তোরা খেয়াল রাখিস তো একজন বাইরের গ্রামের লোক সুবোধ কাকার বাড়ি আসবে। তেমন কাউকে দেখতে পেলে কেউ আমাকে একটু খবর দিস। আমি খেয়াল রাখছি। তবু যদি আমার চোখ এড়িয়ে যায় তাই তোদের বলে রাখলাম। যে দেখবি বলবি।”
ঢোল ডেলিভারী নিতে গেলে পুরো দাম দিয়ে তবে নিতে হবে। বাকি রাখে না সুবোধ রুইদাস। যা দামে রফা হয়ে যায় পুরো টাকাটাই দিতে হয়। একটা পয়সা ছাড়ে না বুড়ো-টা। কিছু টাকা কম হচ্ছে। সেটা জোগাড় না করে তো যাওয়া যাবে না। আজ সন্ধ্যে যাবার কথা ছিল যে ঢোলটা রেডি হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আসার জন্যে। যাওয়াটা এখন বাতিল করা ছাড়া তার উপায় নেই। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিমির পাইক বসে গেল উঠোনে ফেলে রাখা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে। তাকে অন্তত পাঁচটা চুবড়ি আর তিনটে খড়কুঁচে রাখার মত বড় ঝোড়া তৈরী করতে হবে। কঞ্চিগুলো নেড়েচেড়ে দেখল অতটা মাল এগুলোয় হবে কি না। তার সঙ্গে আবার দুটো চুবড়ি আর একটা মাটি বওয়া ঝোড়া আলাদা করে বানাতে হবে। ওগুলো মাগনা যাবে, বাঁশের ঝাড়ের মালিককে দেবার জন্যে। ওদের এদিকে এই একটা সুবিধা আছে, বাঁশ ঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে নিয়ে আসার জন্যে ঝাড়ের মালিককে আলাদা করে তার দাম দিতে হয় না। ওই থাবগো মূল্য ধরে সেই দামের চুবড়ি-ঝোড়া দিলেই চলে। তাতে তিমিরদের মত কাওরা-পাইকদের একটু লাভ বেশি হয়। ঝাড়-মালিকরা তো অতো বোঝে না, ক’টা কঞ্চিতে ক’টা চুবড়ি-ঝোড়া হতে পারে। তাছাড়া ওরা এই নিয়ে তেমন ভাবেও না। ঝাড় থেকে বাঁশ বিক্রি করার সময় কঞ্চি এমনিতেই বাঁশ গোলার ব্যবসায়ীরা ফেলে দিয়ে চলে যায়। ঝাড়ের মালিকদেরও এটা জ্বালানি ছাড়া আর কোন কামে লাগে না। আগে লোকে এই কঞ্চি ছিটেবেড়ার ঘর করতো। তখন কঞ্চির চাহিদা ছিল। এখন তো ছিটেবেড়ার বা মাটির বাড়ি প্রায় দেখাই যায় না। তবে একদম নেই তা জোর দিয়ে বলার সাহসও কারোর নেই। প্রান্তিক এলাকায় তেমন বাড়ি আছে বইকি। সেসব তো তাদের এই এলাকার নজরের বাইরে। বাজারে তাই এখন কঞ্চির এমন চাহিদাও নেই যে ঝাড় মালিকরা দর হাঁকিয়ে গেঁট হয়ে বসে থাকবে।
অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেও অর্ধেকের বেশি মাল তৈরী করতে পারেনি তিমির। আর শরীর টানছিল না। এবার শুতে যেতে হবে। না হলে আবার সকাল সকাল ওঠা যাবে না। সকাল থেকে আবার কাজে লাগতে হবে। শুতে যাবার সময় ঠিক করে, তার ঢোলের মেন সহকারী, শিশিরকে একবার ডেকে নেবে। দু’জনে হাতে হাতে কাজ করতে পারলে দুপুরের মধ্যে কাজগুলো সাল্টানো যাবে। সেই ভেবে পরদিন ভোরেই শিশিরের বাড়ি যায় তিমির। গিয়ে দেখে, শিশির তাদের ঘরের সামনে উঠোনে উঁচু দাবা মত করে রাখা জায়গায় মাটির ডোঙার ভেতরে থাকা মাছের মীন নিয়ে নাড়াঘাটা করছে। তিমির জিজ্ঞেস করে,“কি করছিস ওখানে শিশির?”
-এই যে কাকা। একসপ্তা হল নৈহাটি থেকে কই, মাগুর আর তেলাপিয়ার ডিম নিয়ে ছেড়েছিলাম। এখন সেই ডিম থেকে প্রচুর মীন জন্মেছে। সেগুলোকে দেখভাল করতে হচ্ছে। ঠিক ঠিক নিয়ম মেনে এগুলোকে না দেখলে আবার এদের মড়ক শুরু হয়ে যাবে। আমার লাভের গুড় পিঁপড়েতে খেয়ে নেবে। আষাঢ়, শ্রাবণ আর ভাদ্র। এই তিন মাস তো মীনেরা আমাদের সংসার চালায় দাদা। সে তো তুমি ভালোই জানো। কোন কাজ নেই এই বর্ষায়। কিছু তো করতে হবে। আর বর্ষায় কাদা জাবড়ে বাঁশ ঝাড় থেকে কঞ্চি যোগাড় করা আমার পোষায় না। তোমার অবশ্য তাতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমি পারি না। তাই এখন বড় বড় কুমোর-হাঁড়িতে বাঁকে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মীন বেচে সংসার চালাতে হয়। যাকগে। আমার কথা ছাড়ো কাকা। কি বলতে এসেছো সেটা বলো। এবার তোমার কথা শুনি। শিশির বলল।
– তোর কাজ কারবার দেখে আমার তো বলার ইচ্ছেটা চলে গেল। এইসব মীন-টিন নিয়ে যা এখন ফেঁদে বসেছিস। পারবি তুই আমার কথা রাখতে? তাই বলতে কিন্তু কিন্তু করছি।
-আরে কাকা, বলতে এসেছো যখন, তখন বলেই ফেলো। তোমার বলাটা আমি রাখতে পারি কি না দেখি। না শুনলে আমি বা হ্যাঁ-না বলি কেমন করে। এবার যেন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে তিমির বলল, “রুইদাস পাড়ার সুবোধ রুইদাসের কাছে একটা ঢোল তৈরী হয়ে পড়ে আছে। কিছু টাকা কম পড়েছে বলে আনতে যেতে পারছি না। আরও দুটোর অর্ডার দেওয়া আছে। এইটার
ডেলিভারী না নিলে অন্যগুলোতে হাত দেবে না। এটার দাম মেটালে সেই টাকা দিয়ে আবার অন্য দুটোর মাল-মেটিরিয়ালস কিনবে। তা আমি ইতিমধ্যে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে কয়টা চুবড়ি আর ঝোড়া বানিয়েছি। আরও কয়েকটা না বানালে পুরো দাম হবে না। বর্ষার পরেই তো পুজোর মরশুম। আমরা ঢোল বাজাতে বার হবো। সারা বছরের আয় তো বলা যায় এই সময়ই করে নিতে হয়। সেটা তো হাতছাড়া করা যায় না। তোরও না, আমারও না। তাই বলছিলাম কি যদি তুই আমার সাথে হাত লাগিয়ে কাজ কটা তুলে দিতিস তো আজ মালটা ডেলিভারী নিতে পারতাম। শুধু আনলেই তো হল না। ওটাকে বাড়ি নিয়ে এসে সুর বেঁধে বাজিয়ে দেখতে হবে, সব ঠিকঠাক হয়েছে কি না। বেসুরো গাইলে আবার নিয়ে যেতে হবে। সেইজন্যে একটু তাড়া ছিল আরকি।”
-কাকা, তুমি তো দেখছো আমি কিভবে এ’কাজে জড়িয়ে পড়েছি। এক্ষুনি আমাকে এই ধানি-মীনগুলোকে হাঁড়িতে তুলে বাঁক নিয়ে দৌড়তে হবে পাড়ায় পাড়ায়। ফিরতে ফিরতে সেই বেলা বয়ে যাবে। তারপর খেয়ে দেয়ে একটু জিরিয়ে না হয় তোমার সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে পারি। তার আগে তো আমার সময় হচ্ছে না কাকা। তুমি কিছু মনে কোরো না।” বলে শিশির, গুড় শিউলীদের গুড় জাল দেওয়া ইঞ্চি ছয়েকের মত উঁচু করে চারধার ঘেরা টিনের চ্যাটকা ডোঙা বা পাত্রর মত হুবহু দেখতে মাটি দিয়ে তৈরী পাত্র থেকে ধানি মীন তুলে হাঁড়িতে ভরতে থাকে। তাড়াতাড়ি বার হতে হবে। রোদ মাথায় উঠে গেলে আবার সেই তাত মীনেরা সহ্য করতে পারে না। অক্কা পায়!
শিশিরের কাজের পরিস্থিতি দেখে তিমির আর চাপ দিতে পারল না তাকে। “ঠিক আছে, তুই তোর কাজ কর” বলে সোজা চলে গেল তার আর এক সাগরেদ, পরাগের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখে পরাগ আর তার বউ, দুয়ে মিলে এক বান্ডিল মাথা কাটা তালডাগ নিয়ে সেই ডাগের উপরের চকচকে ছাল ছলতে ব্যস্ত। তিমির ভালই জানে এই তালডাগের ছাল দিয়ে ওরা কি করবে। আগে বহুদিন সে ধান-চাল পাছড়ানো কুলো বানিয়েছে। বড্ড খাটনি। তাই ছেড়ে দিয়েছে এই কাজ। কঞ্চির চেটা দিয়ে কুলোর ধড় বানাতে হয়। তারপর বাঁশের বাঁখারি চেঁছে তার সঙ্গে কুলোর ধড়টা কষে বাঁধন দিতে হয়। তাল ডাগের ওই শক্ত ছলা ছাল দিয়ে বাঁধনটা দিলে আর সহজে কুলোর ধড় থেকে চারধারের বাঁখারির বাঁধন খুলবে না। বড়ই মেহনতের কাজ। তবু পেটের টানে তাদের জাতেরা এই কাজটাও চালিয়ে যায়, যখন ঢোল-কাঁশির বাজনার কাজে মন্দা থাকে। এই মীন, চুবড়ি-ঝুড়ি বা কুলো- সবই তাদের অসময়ের অন্নদাতা। তিমির কাকাকে হঠাৎ দেখে কাজ থামিয়ে দেয় পরাগ, “কিগো কাকা, হঠাৎ! কি মনে করে?” হতাশ হয়ে তিমির বলে,“বলবো কি। শিশিরের কাছে গেলাম, সে মীন নিয়ে জেরবার। তোর কাছে এলাম তুই কুলো নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিস। ভাবছিলাম তোকে নিয়ে যাব আমার কাজে একটু যোগান দেবার জন্যে। তা তো হবার নয় দেখছি। আজও রুইদাসের কাছ থেকে ঢোলটা আনা যাবে না। আমি একা এতগুলো ঝোড়া-চুবড়ি একদিনে শেষ করতে পারব না। তৈরী হওয়া মাল পড়ে থেকে ড্যামেজ না হয়ে যায়। রুইদাস জানিয়ে দিয়েছে মাল রেডি। এরপর ড্যামেজের দায় সে আর নেবে না। এবার পুজোয় ঢোলের বায়না ধরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে মনে হয়। দলের সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। সব দায় যেন আমার।” বলে মনে মনে গজগজ করতে করতে পরাগের বাড়ি থেকে চলে আসে তিমির।
[চুয়াল্লিশ]
সপ্তাহ খানেক পর সেদিন সবেমাত্র সনাতন সকালের টিউশনির ব্যাচটা শেষ করে টিফিন করতে শুরু করেছে। তার সন্ধ্যের ব্যাচের ছাত্র, চঞ্চল ছুটতে ছুটতে এসে তাকে বলল, “স্যার, সুবোধ দাদুর বাড়ির সামনে আমরা খেলছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা বাইরের লোক দাদুর ঘরে ঢুকলো। তখন তোমার কথা মনে পড়লো। ওই যে তুমি বলেছিলে না, বাইরের কেউ সুবোধ দাদুর বাড়ি এলে খবর দিতে? তাই ছুটে এলুম তোমাকে জানাতে। চলি স্যার।” বলে চঞ্চল আবার দৌড় মারলো। ছেলেটা এতই ছটফটে, আরও দু’এক কথা জিজ্ঞেস করবে। সে সুযোগ দিল না। সনাতন অবশ্য বুঝে গেছে বাইরের ওই লোকটা, ওস্তাদ ঢোলক তিমির পাইক। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে মায়ের তৈরী জলে ভেজানো আধ খাওয়া চিনি-মুড়ির বাটি থালা দিয়ে ঢেকে রেখে ছুট মারলো সুবোধ কাকার বাড়ির পানে।
তিমির পাইক তখন দেরিতে আসার জন্যে সুবোধ কাকাকে কৈফিয়ৎ দিয়ে চলেছে। সেই সময় সনাতন ঢুকতে সুবোধ কাকা বলল, “এই সনাতন এসে গেছে। ও আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে। খুব ভালো ছেলে। তোমার সাথে ওর কি বিশেষ দরকার আছে তিমির। আগে ওর কথাটা সেরে নাও। সনাতন কাজের মানুষ। সময় ওর কাছে অনেক দামি।” পরিচয় করে দিতে সনাতন প্রথমে তিমির কাকাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে সুবোধ কাকার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “কাকা, আমি নয়, আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করেছে, পাড়ার গর্ব, অলোকা দিদি। লেখাপড়া শিখে স্কুলে মাস্টারী করছে। এটাই তো আসল মুখ উজ্জ্বল করা ঘটনা!রুইদাসদের জীবনে ইতিহাস সৃষ্টিকারি ঘটনা হয়ে গেল।” সনাতনের কাছ থেকে এই সংবাদে উৎফুল্ল হয়ে তিমির কাকা বলল,“তাই নাকি! সে তো বিশাল ব্যাপার। ভালো ভালো। খুব ভালো খবর। তা তুমি বলো তো বাবা, কি তোমার কথা?” মন থেকে যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে সনাতন কোলকাতার সন্তোষবাবুদের দূর্গা পূজার মন্ডপের সমস্ত গল্প বিস্তারিতভাবে জানিয়ে ঢোল বাজাবার প্রস্তাব দিল। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল তিমির পাইক। বলল,“সনাতন, তুমি বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট হলেও, প্রথম আলাপে তোমার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। তোমার প্রতি আমার মনে শ্রদ্ধা ভাব জেগে উঠেছে। বুঝেছি তুমি ঠুনকো মনের ছেলে নও। সেই তুমি যখন আমাকে নির্বাচিত করেছো তোমার তৈরী বাগানে ফুল ফোটানোর জন্যে আমরা প্রস্তুত। আশাকরি তোমার সেই মান আমরা রাখতে পারবো। তোমার সাজানো বাগানকে নেড়া বাগান করে আসব না। আবার যেদিন আসব, তোমাদের বাড়িতে যাব। সব ঠিকানা ফোন নম্বর নিয়ে কোলকাতার ওনাদের সঙ্গে আলাপ করে নেব।”
কথা হয়ে যাবার পর আর সময় না খাইয়ে সুবোধ কাকার বাড়ি থেকে ফেরার পথে অলোকাদির সঙ্গে দেখা সনাতনের। বোঝাই যাচ্ছে দিদি স্কুলে যাচ্ছে। দু’জনের পরস্পরের হাসি বিনিময় করার পর অলোকাদি বলল, “আমাকে নিয়ে তোমাদের সভাটা এই মাসের শেষে, মানে আঠাশ তারিখে হবার কথা-না, ভাই ? ওই তারিখে আমি তো থাকতে পারব না।
ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার প্রচুর খাতা আমার কাছে এসেছে। সেগুলো দেখে সঙ্গে সঙ্গে জমা দিতে হবে। রেজাল্ট বার করার জন্যে। ওই সময় একটা মুহূর্ত আমি নষ্ট করতে পারব না। তোমরা বরং অনুষ্ঠানটা বাতিল করে দাও। কি হবে এ’সব করে। আমার অস্বস্তি হয়।”
-ঠিক আছে দিদি। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো না। কাজ আগে। তারপর অন্যকিছু। অনুষ্ঠান আমরা পিছিয়ে দিচ্ছি। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলে আবার দিন ঠিক করব। তবে অনুষ্ঠান বাতিল হবে না। এটা আমাদের রুইদাসদের জাত্যাভিমানের প্রশ্ন। আমাদের জাতের গরিমা করার সুযোগ যখন একবার এসেছে, সেই সুযোগকে হেলায় বইয়ে দেব কেন! তার সদ্বব্যহার আমাদের করতেই হবে। তুমিই হবে তার মধ্যমণি।” কথাগুলো বলে কয়েক মুহূর্ত থমকে যায় সনাতন। পরে মুখটা গম্ভীর মত করে বলল, “তোমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো দিদি? বেশি সময় নেব না। বিশেষ কথা। তাই বলতেই হবে তোমাকে।” তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, কেউ কাছাকাছি আছে কি না। কেউ নেই ! তবু সন্তর্পনে বলল, “বিপ্লবদা সেদিন কেমন প্রচন্ড এক ঝড় অতিক্রম করা বিধ্বস্ত মানুষের চেহারা নিয়ে আমাদের বাড়ি এল! এমন চেহারায় বিপ্লবদাকে আমি কোনদিন দেখিনি। সবসময় ফিটফাট প্রাণবন্ত বিপ্লবদাকে দেখে এসেছি। দেখে আমারও মনটা দমে গেল। আমি ছুটে গিয়ে হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে আসতে গেলাম। এল না। শুধু বলল, “তোমার অলোকাদির সঙ্গে আমার খুব দরকার ছিল সনাতন। কি করে দেখা করি বলো তো?” উত্তরে আমি কিছু বলার আগেই বলল,“ঠিক আছে। এখন আমি আসছি। পরে কোনদিন অলোকার সঙ্গে দেখা করে নেব’খন।” বলেই হনহন করে বাজারের দিকে যাবার বড় রাস্তা ধরে চলে গেল। ঠিক তার একদিন পর হেড়ো পাগলা হঠাৎ আমার রাস্তা আগলে বলে, “খুব ঝামেলা হয়েছে বিপ্লব দাদাবাবুর বাড়ি। ওর বাবা ওকে যাচ্ছেতাই বলে পচাল দিয়েছে। আমি রাস্তা থেকে শুনেছি। তারপর জানিনি, কি হয়েছে না হয়েছে।” মনে হয় হেড়ো পাগলা ভুল কিছু বলেনি। ও তো সবসময় রাস্তায় পায়চারি করে বেড়ায়। শুনে থাকতে পারে চেঁচামেচিগুলো!”
-হ্যাঁ। আমিও তো বিপ্লবদাকে দেখতে পাচ্ছি না। তা অনেকদিন হয়ে গেল। কথাও ছিল অনেক। তোমার সঙ্গে যদি কোনদিন আবার দেখা হয় তো বোলো তো? যদি কোথাও দেখা করতে পারি। ভাল হয় তাহলে। মনটাও যেন কেমন ‘কু’ ডাকছে। এখন চলি ভাই। স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে। আর দেরি করা যাবে না। বলে স্কুলের পথ ধরে অলোকা।
অলোকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সনাতন, তাদের রুইদাস পাড়ার রাস্তা আর সরকারি বড় রাস্তার তেমাথানির মোড় পর্যন্ত চলে আসে। মোড়ের পুরোনো বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অলোকাদির চলে যাওয়াটা দেখতে দেখতে কি যেন ভেবে উদাস হয়ে যায়। ভাবে, অলোকাদি বিপ্লবদাকে কত ভালোবাসে। বিপ্লবদাও তেমন অলোকাদি ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারে না। ওর আন্তরিক ভালোবাসা আর প্রেরণাতেই তো অলোকাদির এই সাফল্য। সেটা অলোকাদি কেমন করে অস্বীকার করবে! করেও না অলোকাদি। তাই সে যখন বিপ্লবদার বিধ্বস্ত অবস্থার কথা বলল, তখন সনাতন লক্ষ্য করল, অলোকাদির চোখমুখ কেমন যেন পানসে হয়ে গেল। দুর্মর ভালবাসা ছাড়া এই প্রতিক্রিয়া কারোর হতে পারে না। কিন্তু ওদের দু’জনের সমাজ তাদের এই অসবর্ণ মেলামেশা এবং তার পরিণতিতে বিয়ে কিছুতেই মেনে নিতে চাইবে না। তার অশনি সংকেত যেন এখন থেকেই সে দেখতে পাচ্ছে। সনাতনের মনটা সেই ভেবে একদম ভালো নেই। এমন সময় তাদের পোস্ট অফিসের ডাক পিওন, কোচি-দা সাইকেল নিয়ে এসে থামে তার সামনে। বলে,“আচ্ছা সনাতন ভাই, তুমি কি বলতে পারবে, এই সম্পদ সরকার নামটা কার? তোমাদের পাড়ার ঠিকানা দেওয়া আছে। এত বছর ধরে আমি এই কাজ করছি। কয়েকটা গ্রামের প্রায় সব লোকের বাড়ি আমার যাতায়াত এই চিঠি বিলির সূত্রে। ‘সরকার’ পদবির কেউ এই চত্বরে আছে বলে তো আমার জানা নেই। এখানে এই পদবি কবে থেকে আমদানি হল কে জানে!”
কোচি পিওনের কথায় খানিক চিন্তায় পড়ে গেল সনাতন। ‘সরকার’ পদবি! তাও আবার তাদের রুইদাস পাড়ার ঠিকানা! সম্পদ নামে তো তাদের পাড়ায় একজনই আছে। সে তো সম্পদ ঋষি। কোলকাতায় ঠিকাদারি করে এখন। ভাল পয়সা করে ফেলেছে। নাইনে পড়তে পড়তে স্কুল পালিয়ে কোলকাতায় রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজে ভিড়ে যায়। বহুদিন তার পাড়ায় দেখা যায়নি। হঠাৎ একদিন সুটেড বুটেড হয়ে পাড়ায় তার আবির্ভাব! তাকে দেখে তো পাড়ায় সবাই হতবাক! চেহারা চালচলন দেখে মনে হল ভালই পয়সা করেছে। পুরোনো খড়ের বাড়ি ভেঙে একসাথে সেখানে দোতলা বাড়ি হাঁকিয়ে দিল। আটচালার উন্নতির জন্যে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা ডোনেশান দিল। বখে
যাওয়া ছেলেরা তার পিছে পড়ে গেল মদ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে। সে-ও দু’হাত উপুড় করে তাদের আর্জি মত সব ব্যবস্থা করে দিল। পাড়ার ওইসব ছেলেরা সম্পদ ঋষির প্রসংশায় পঞ্চমুখ। তাদের কাছে তখন সম্পদ ঋষি আর দিলখুস সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাস দুই পাড়ায় থেকে একতলাটা বসবাসের উপযুক্ত করে বানিয়ে আবার উধাও সম্পদ ঋষি। সুবোধ কাকার বাড়ির পাশেই তার অট্টালিকা। বাড়ি তৈরীর সময় সুবোধ কাকা সম্পদকে জিজ্ঞেস করেছিল,“হ্যাঁরে কাকা, তুই তো পড়া পারতিস না বলে ক্লাসে মাস্টারের কাছে বেতের বাড়ি খেতিস। সেই অপমানে পড়া ছেড়ে দিয়ে মিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজে কোলকাতায় চলে গেলি। মাথা তোর কোনোদিন পরিষ্কার ছিল না বলেই বেতের বাড়ি খেতিস। হঠাৎ তোর মাথা এমন সরেস হয়ে গেল যে গুচ্ছের টাকা আয় করতে শুরু করলি!”
সুবোধ কাকার কথায় মুচকি হেসে সম্পদ বলল,“কাকা, মাথা পরিষ্কারের জন্যে না। ভাগ্য সহায় হবার ফলে আমার কপাল খুলে যায়। বাবুর ভীষণ নেওটা ছিলাম। একসময় বাবু আমাকে এত বিশ্বাস করে ফেলল যে আমি ছাড়া কন্ট্রাক্টর বাবু এক পা চলতে পারতো না। আমারও ভাগ্যের হাত ধরে বুদ্ধি খুলতে লাগল। বাবুর বউ বাঁজা ছিল। আমি তার সন্তানের মত হয়ে গেলাম। পরের দিকে যারা আমাদের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় তারা জানতো আমি বাবুর ছেলে। তা একদিন বুকের ব্যথায় বাবু চলে গেল। ছেলে হিসেবে বাবুর সব কাজ করলাম। গিন্নিমা এখনো বেঁচে আছে। আমি বেইমানি করিনি গিন্নিমার সঙ্গে। এখনো গিন্নিমাকে আমি মায়ের চোখে দেখি। ব্যবসার সব টাকা পয়সা গিন্নিমার ব্যাঙ্কের খাতায় রাখি। ইদানিং গিন্নিমা আর ওসব দেখে না। সবটাই আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে। দিয়ে একটা সাংঘাতিক কথা আমাকে বলেছে গিন্নিমা। বলেছে,“বাবু, আমাদের সব সম্পত্তি তোর করে দিয়ে গেলাম। এরপর যদি তুই ভাবিস আমি তোর পথের কাঁটা হয়ে রইলাম তাহলে তুই আমার মুখে বালিশ চাপা দিয়ে দম আটকে মেরে দিস।” কথাটা সুবোধ কাকাকে বলতে বলতে সম্পদের গলার কাছে কে যেন দলা পাকিয়ে কথা আটকে দেয়। খানিক থেমে আবার বলে, “গিন্নিমার সেই কথায় আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। প্রতিজ্ঞা করে বলি, জীবন দিয়ে আমি তোমার পাশে থাকব গিন্নিমা। এমন কথা দ্বিতীয়বার বলে আমাকে কষ্ট দিও না।” সুবোধ কাকা এইসব কথা একদিন আটচালায় বলছিল। ভাল চিন্তার মানুষরা তাকে বাহবা দিয়েছে। আর যারা লোভী তারা তাকে ‘বোকা’ দেগে দিয়ে আফসোস করেছে। এরপর বছর গড়িয়ে গেছে সম্পদের পাত্তা নেই পাড়ায়। পাড়া তাকে ভুলতে বসেছে। সেইসময় দিনু ঋষি বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। তাকে জিজ্ঞেস করতে দিনু বলে, “ও তো আমাদের সম্পদ ঋষি গো। তোমরা জানো না? ও কোর্ট থেকে এফিডেভিট করে বাপ পিতেমহের পদবি বদলে ফেলেছে। পয়সা হয়েছে। তাই জাতে উঠে গেছে। রুইদাস তো ছোট জাত। এই টাইটেল শুনলে লোকে নাকি তাকে বেঁকা চোখে দেখে। তাই জাতে ওঠার জন্যে পদবি পরিবর্তন করে ‘সরকার’ হয়েছে। ছিঃ ছিঃ। এতকিছু করে শেষ পর্যন্ত নিজের জাত খোয়ানোর ইচ্ছে হল! এখন ওর বিরুদ্ধে কে কথা বলতে যাবে? অঢেল পয়সা। পয়সায় পাড়ার সকলকে কিনে রেখেছে। আটচালাকেও তো শুনেছি কিনে নিয়েছে। তাই আটচালা ওকে কিছু বলছে না। তা আমরা ছাপোষা মানুষ। দিন আনি দিন খাই। আমাদের কথা কে শুনবে বলো?”
দিনু ঋষির কাছ থেকে ঘটনাটা জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল সনাতনের। পয়সার গোমরে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করতে পারে? তার জন্মসূত্রকে এত সহজে অস্বীকার করে ফেলতে পারে? যে তা করে, সে কেমন মানুষ? এ তো নরকের কীটেরও অধম। জন্মসূত্রে আমরা অধিকারী হয়েছি আমাদের এই জাতটাকে লালন করার। আমরা এই জাতকে লুপ্তপ্রায় জাতে পরিণত করতে পারি না। একে টিকিয়ে রাখা আমাদের জন্মাধিকার। সুবোধ কাকার কাছে ওর বৃত্তান্ত শুনে সম্পদের প্রতি মনে মনে একটা স্বস্তিবোধ জেগেছিল। এখন তো তাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে। ‘সরকার’ পদবি নিলে কি সে আর ‘মুচি’ রইল না! ‘সরকার’ এসে ‘মুচি’কে মুছে দিল! কি জাত হল তাহলে এখন সে? একাধারে সে সাধারণ মানুষের কাছে নিজের জন্মবৃত্তান্তকে লুকিয়ে রাখল। আর স্বজাতিকে বার্তা দিতে চাইল যে সে এই মুচি জাতটাকে ঘৃণা করে। তাই যে সূত্র ধরে তার জন্ম সেই জন্মসূত্রকে অস্বীকার করছে। অস্বীকার যখন সে করছে তখন তাদের এই জীবনযাত্রার মধ্যে তার ঠাঁই হওয়া তো উচিৎ নয়। আটচালাকেই এখন ঠিক করতে হবে জাতভ্রষ্টকে পাড়ায় ঠাঁই দেওয়া হবে কি না। এখনই আটচালাকে তাকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। নচেত ভবিষ্যতে এই প্রবণতা বাড়তে থাকবে। তখন তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে সমাজের প্রান্তিক এই সম্প্রদায়টা।
কোচি পিওনের কাছ থেকে চিঠিটা দিনু ঋষিকে নিয়ে নিতে বলল সনাতন। বলল,“ও তো তোদেরই জ্ঞাতি ভাই। তার অনুপস্থিতিতে তুই চিঠিটা নিয়ে রাখ। পরে ওটা দরকার হতে পারে। আটচালা যখন আনতে বলবে নিয়ে আসবি।”
আটচালার এবারের মিটিংয়ে পাড়ার সমস্ত সিনিয়র মানুষদের উপস্থিত থাকা জরুরী বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসেছেও সব্বাই। আলোচনা শুরু হবার আগে সনাতন তার ভাবনাগুলো বক্তব্যের আকারে সভায় ব্যক্ত করে। সব শুনে সুবোধ কাকা বলল, “এতো তাদের রুইদাসদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। একজনকে যদি এমন অপকর্ম করার জন্যে শাস্তি দেওয়া না হয় তো আর একজন পয়সার গরম দেখিয়ে বলতে পারে এই মুচি জাত নীচু জাত। এই জাতের পদবি আমি মানব না। এর ফলে পাড়ায় তো একদিন জাত-বেজাতের সমাহার হয়ে দাঁড়াবে। পুরোপুরি অস্তিত্বের সঙ্কটে এসে দাঁড়াবে রুইদাসরা। দেখা যাবে একটা সময় পর পরবর্তী ধাপের সন্তানসন্ততিরা জানতেই পারবে না চর্মকার-মুচি জাত বলে একটা স্বতন্ত্র জাত এই গ্রামে ছিল। আমরা বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না। সম্পদের অঢেল সম্পদ আছে, থাকুক। যেমন বিদেশে আছে নিজের গোমর নিয়ে থাকুক। আমাদের তাতে কোন আপত্তি নেই। আবার এফিডেভিট করে নিজের পদবিতে ফিরে না এলে ওকে এই পাড়ায় ঠাঁই হবে না। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে ওর তৈরী হতে থাকা পাকা বাড়ি। তার আগে ওকে একবার সুযোগ দেওয়া হবে ভুল শোধরানোর। তা না শুনে পয়সার জোরে পুলিশ দিয়ে এখানে কিছু করতে পারবে না। পুলিশ খুব ভাল করে জানে এই রুইদাস পাড়ার অনুশাসন। ওরা কোনদিন আটচালার কাজে মাথা গলায়নি। এখনো গলাবে না।” সম্পদের জ্ঞাতি, দিনু ঋষিকে ভার দেওয়া হল আটাচালার এই সিদ্ধান্ত তার কানে পৌঁছে দেবার জন্যে। সম্পদের পয়সার দম্ভের কথা ভেবে প্রথমদিকে খবরটা পৌঁছে দেবার ব্যাপারে ঘোঁত ঘোঁত করছিল দিনু। পরে চাপে পড়ে রাজি হয়। পাড়ার উপস্থিত সকল মানুষ এক বাক্যে সুবোধ কাকার সমস্ত মতামতকে স্বীকার করে নেয়। সনাতনের ভাবনার সঙ্গে সুবোধকাকার ব্যাখ্যা হুবহু মিলে যায়। স্বস্তিবোধ করে সে।
পঞ্চায়েত নির্বাচন আগামী তিন মাসের মধ্যে হবে বলে রাজ্য নির্বাচন কমিশন থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখন সেই নিয়ে ব্যস্ততা তুঙ্গে। জনসংখ্যার নিরিখে সনাতনদের পাড়া থেকে এবার একজন সদস্যর কোটা নির্ধারিত হয়েছে। এলাকার মূল দুই রাজনৈতিক শিবিরের দৃষ্টি এখন ওদের পাড়ার দিকে। রুইদাস পাড়া থেকে কাকে তাদের দলের প্রতিনিধি করা যায় সেই নিয়ে চুলচেরা আলোচনা চলেছে দুই দলের মধ্যে। মূলত এ’পাড়ার কোন লোকটার প্রতি মানুষের ভালো প্রভাব তাই নিয়েই চর্চা। অপরেশ সর্দারদের দল এখন প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে দীর্ঘ বছর রাজ্যের ক্ষমতায়। সেই দলের মুখের উপর কথা বলার সাহস এখন সাধারণ মানুষের তো নেই-ই, বিরোধী দলেরও নেই! অপরেশ সর্দার একদিন দলবল নিয়ে হাজির সনাতনদের বাড়ির উঠোনে! সনাতন তখন টিউশনি পড়াচ্ছে। সকালের ব্যাচের পড়ানো তখন প্রায় শেষের দিকে। এলাকার ডাকসাইটে নেতা, অপরেশবাবুকে কে না চেনে। তাকে দেখেই সনাতন উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে সনাতন বলল,“আসুন আসুন দাদা। দাবায় উঠে আসুন।” তার ছাত্রী, সুন্দরীকে দাবায় দুটো বড় মাদুর বিছিয়ে দিতে বলল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাচটাকে ছুটি দিয়ে দিল। সনাতনের আহ্বান মত ওনারা এসে দাবায় বসতে বসতে বলল, “তোমার সঙ্গে একটা বিশেষ দরকারে আমরা এসেছি। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আবহে আমরা এসেছি মানে বুঝতে পারছো দরকারটা ব্যক্তিগত নয়, রাজনৈতিক।” সঙ্গে সঙ্গে সনাতন বলল, “সে কথা তো হবে। তার আগে যদি অনুমতি দেন তো একটু চায়ের ব্যবস্থা করি। আপনাদের মত বড় মানুষ আমাদের এই গরিব ঘরে এসেছেন। সামান্য একটু চা দিয়ে যদি আপ্যায়ন করতে পারি তো আমরা ধন্য হয়ে যাব।”
সনাতনের কথা এবং ব্যবহারে তৃপ্ত বোধ করে অপরেশবাবু। পাশে বসে থাকা সহকর্মীকে ফিসফিসিয়ে বলল, “ছেলেটা বেশ সোবার তো? তোমাদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত মনে হচ্ছে তো একদম সঠিক। এই ছেলের জনভিত্তি না থেকে পারে না। এখন তার পছন্দের ছেলে যদি চায়ের অফার করে প্রত্যাখ্যান করে কি করে। কথা না বাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে দেয় অপরেশবাবু।
অন্য ছাত্রীদের ছুটি দিলেও সুন্দরীকে থেকে যেতে বলে, সনাতন। এতগুলো লোক তার বাড়িতে এসেছে। চা-টার তো ব্যবস্থা করতেই হবে। সেটা আগাম বুঝে সুন্দরীকে আটকে দেয়। মা একা সবকিছু সামলাতে পারবে না। সম্মতি পেয়ে সুন্দরীকে তাড়াতাড়ি চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে অপরেশবাবুদের কাছে এসে বসল সনাতন। বলল, “বলুন দাদা আপনার মত বড় মানুষের আমার কি দরকার?” অপরেশবাবু বলল, “সনাতন তোমাকে আমাদের দলের প্রতিনিধি হয়ে তোমাদের পাড়ায় দাঁড়াতে হবে। তুমি জানো কি না জানিনা, এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে তোমাদের রুইদাস পাড়া, পালপাড়া এবং পদ্মরাজ পাড়া নিয়ে একটা নতুন সীট বেড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী জনসংখ্যার নিরিখে এটা হয়েছে। এটা আমাদের লোক্যাল কমিটির প্রস্তাব এবং জেলা কমিটি থেকে তা মঞ্জুর হয়ে এসেছে। আমরা এসেছি তোমার সম্মতি নিতে।”
সনাতন কোনদিন ভাবেনি যে রাজনৈতিক দল থেকে এমন প্রস্তাব তার কাছে কোনদিন আসতে পারে। কেননা সে কোনদিন রাজনীতির ধারেকাছে যায়নি। ভালও লাগে না তার। তার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা গেঁথে আছে যে রাজনীতি মানেই হইহুল্লোড়, মারপিট, মিথ্যাচার, হিংসার বাতাবরণের মধ্যে জড়িয়ে থাকা আর ক্ষমতা ভোগের অহমিকা। আর এই ধারণা তার মন থেকে মুছে ফেলা মুশকিল। অপরেশবাবুর মত বড় নেতা এসেছে মানেই গদগদ হয়ে বা ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে তার কথায় মাথা হেলে দেবে, সে ধাতের ছেলে নয় সনাতন। সে বলল,“দাদা, আমি কোনোদিন রাজনীতি করিনি। কোন দলের হয়ে কোনও কাজ করিনি। সেই আমাকে কেন আপনাদের দলে টানতে চাইছেন বুঝতে পারছি না। সেইসঙ্গে আর একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দিই, আমি কিন্তু ভবিষ্যতেও কোনদিন রাজনীতিতে ঢুকব না। আমি পছন্দ করি না। দয়া করে আমাকে এই অনুরোধটা করবেন না। বলে সনাতন চায়ের দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।”
অপরেশবাবু মনে মনে ভাবল, এই ছেলেটা যেমন ভদ্র তেমন দৃঢ়চেতাও বটে। এমন ছেলেকেই আমাদের দরকার। সনাতন সেখান থেকে চলে যাবার পরে সহকর্মীদের সঙ্গে একটু আলোচনা সেরে নিল। তারপর সনাতন ফিরে এলে হাসি মুখে তাকে বলল, “তোমাকে আমরা আমাদের দলের সদস্য হতে বলছি না। তাহলে তো তোমার ভাবনামত তুমি দলগত রাজনীতি করছো না। দলহীন প্রার্থী হতে এরপর নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি থাকার কথা না। আমাদের দলের সমর্থনে তোমাকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে বলছি। পরিষ্কার কথা, তোমাকে, তোমার মত করে আমাদের মধ্যে পেতে চাই।” এরপর সনাতন কোন পাল্টা যুক্তি দিয়ে অপরেশবাবুদের উপেক্ষা করতে পারল না। আসলে এরা হচ্ছে দুঁদে রাজনীতিবিদ। কোন ঠাকুর কোন ফুলে তুষ্ট হয় এরা তা খুব ভাল করে জানে। যুক্তির জালে এমন জড়িয়ে দেবে যে তার থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল।
নির্বাচনে সনাতন বিপুল ভোটে জিতে গেল। তার বিপক্ষ দলের প্রার্থীর জামানত জব্দ হয়ে গেল। অপরেশবাবুর দলও পঞ্চায়েতের দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে পঞ্চায়েতরাজ দখল করে নিল। তাদের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটে লীড দিয়েছে সনাতন রুইদাস। তাছাড়া ওর জীবনশৃঙ্খল, কাজের দক্ষতা এবং মানুষের মনহরণের ক্ষমতা অপরেশবাবুরা পরখ করেছে নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন। অপরেশবাবুর মনে হয়েছে এই সনাতন রুইদাসই প্রধান হবার উপযুক্ত। ওর মত যোগ্য প্রার্থী তাদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে কেউ নেই।
প্রধান হয়ে সনাতনের ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠে গেল। চার ব্যাচ টিউশনি পড়ানোর সময় সে একদম দিতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত সকালের মেয়েদের ব্যাচ এবং বিকেলে তাদের পাড়ার ছাত্রদের ব্যাচ রেখে দিয়ে অন্য দুটো ব্যাচ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। সুষ্ঠভাবে এবং সততার সঙ্গে পঞ্চায়েত পরিচালনার একটা নজির রাখতে শুরু করল সনাতনের দক্ষ হাত। তার নিজের পাড়া থেকে এবার দাবি উঠল, আটচালা পরিচালনায় সনাতনকে যুক্ত করতে হবে। একজন পঞ্চায়েত প্রধান, যে তাদেরই পাড়ার সন্তান সে যদি আটচালার কমিটিতে থাকে তাহলে গ্রামের আরও অনেক উন্নতি হবে। অন্যদিকে পাড়ার একটা ছোকরা, সেদিনের ছেলে, সে কিনা তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠবে? পাড়ার কোনো কোনো বয়স্ক মানুষ সেটা মেনে নিতে চাইছিল না। বিরোধিতাও করেছে। কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠের প্রবল চাপে সেই ক্ষীণ প্রতিরোধ ধোপে টেকেনি।
তখনও নিজের পেচ্ছাপ-পাইখানার কাজটা নিজে সেরে নিতে পারতো রেখা বউয়ের শাশুড়ি। মনে হয় ও বুঝতে পেরেছিল, তার শেষের দিন আর বেশি দূরে নেই। সেই ভেবে রেখার অগোচরে অতীতে বাড়িতে বহুল ব্যবহৃত ছোট্ট কৌটোটা বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখে ভীষ্মর মা। পরপর করেকবার ছোট আকারে বুকের হৃদপিন্ড ধাক্কা খেয়েছে। ডাক্তার বলেছে,খুব সাবধানে রাখতে। চলাফেরা একদম করা চলবে না। ডাক্তারের পরামর্শমত ওষুধপত্রর সব ব্যবস্থা করে রেখেছে অখিল। কিন্তু বিছানাই এখন হয়ে গেল ভীষ্মর মায়ের পৃথিবী। মনে হয় আর বেশিদিন এই পৃথিবী তাকে ঠাঁই দেবে না। বুঝে গেছে রেখার শাশুড়ি।
রেখার কান্নাকাটিতে পাশের বাড়ির বউরা দেখেতে এসে খবরটা চাউর হয়ে যায় মন্ডল পাড়ায়। পাড়ার আরও পুরুষ মহিলারা এসে পড়েছে। রোজকারের মত সকালে অখিলও এসে পড়েছে রুগিকে দেখতে। তখনও বুড়ি হাত-পা নাড়ছে, টুকটাক কথা বলতে পারছে। হঠাৎ বুড়ি অখিলকে কাছে ডেকে নেয়। কোনোদিন এমন কাতরভাবে তাকে কাছে ডাকেনি সে। অবাক করে অখিলকে! আরও যেন অবাক করা দৃশ্যের সাক্ষী হবার অপেক্ষায় ছিল তাদের ঘরের এই ছোট্ট পৃথিবীটা। মেয়ে রেখাকেও কাছে টেনে নেয়। এবার মাথার বালিশের তলা থেকে সেই অমূল্য কৌটো বার করে অখিলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,“আমার মেয়ের সিঁথিতে সিঁদুর দান করো বাবা। যতক্ষণ না তুমি কাজটা শেষ করছো ততক্ষণ যমরাজ অপেক্ষায় থাকবে। আমাকে তুলে নেবে না। তুমি আমাকে মুক্তি দাও বাবা। আমি নিশ্চিন্তে তাহলে ওপারে চলে যেতে পারি।” একঘর পৃথিবীকে সাক্ষী রেখে অখিল রেখার সিঁথিতে হৃদয় উজাড় করে সিঁদুর পরিয়ে দিল। কিছু কালের জন্যে যেন সেই পৃথিবী মূক হয়ে রইল ! মুক্ত হল রেখার মা। নব জীবনের অধিকারিনী রেখার চোখের জলের ধারায় শোধন হতে থাকল তার বৈধব্য জীবন-সহ চরাচরের মলিন যা কিছু সব। সব।
এক গ্রাম সাক্ষী থেকে অখিল রেখাকে বিয়ে করেছে। উল্কার বেগে খবরটা ছড়িয়ে গেল আশপাশের এলাকা সহ তাদের রুইদাস পাড়াতেও। তেতে উঠতে সময় নিল না, অখিলের প্রবল বিরুদ্ধপক্ষ নোচে-বিন্দেদের দল। ছোটাছুটি পড়ে গেল পাড়ায়। প্রবল দাবি উঠতে থাকলো এই অন্যায়ের একটা বিহিত করার জন্যে। আটচালার উপর চাপ আসতে লাগল। কালবিলম্ব না করে অখিলের এই জঘন্য কাজের বিচার করতে হবে।
বিচারসভায় অভিযোগকারিদের পক্ষে অভয় বলল,“একজন বেজাতের বিধবা বউকে বিয়ে করে অখিল তাদের রুইদাসদের মানসম্মান মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছে। ওকে অনেক আগে থেকে সাবধান করা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে এই নোংরা কাজ করেছে। ব্যবসার ছুতোয় অখিল মেয়েদের সঙ্গে অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকে এটাই তার প্রমাণ। ওকে গ্রামছাড়া করা হোক। নাহলে অন্যেরা এই কাজে প্রভাবিত হতে পারে। তা তাদের সমাজের পক্ষে চরম ক্ষতিকর হবে। এই নোংরামো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।”
এবার অখিলের বলার সুযোগ আসতে সে বলল,“জেনেশুনেই সে একজন অরক্ষণীয়া স্বামীহারা মেয়ের পুর্ণজীবন দান করেছে। রেখার শাশুড়ি মারা যাবার পর ওকে রক্ষা করার জন্যে পৃথিবীতে কেউ ছিল না। নাহলে একটা স্বল্পবয়সী অসহায় যুবতীর শরীর কুকুর-শেয়ালে ছিঁড়ে খেতে পারতো। জাতপাতের উর্দ্ধ্বে যদি কেউ কারোর কাছে জীবনভিক্ষা চায় আমাদের প্রথম কর্তব্য হয় সাধ্যমত তার পাশে দাঁড়ানো। আমি ঠিক সেই কাজটা করেছি। আমি তো আমার জাত খোয়াইনি! মানবতার পাঠ নিয়েছি। আমি নির্দোষ। এই অন্যায় অভিযোগ থেকে আমাকে আটচালা রেহাই দিক, এটাই আমার প্রার্থনা।” এরপর অভিযোগকারিদের কোনো কথা বলার আছে কি না প্রশ্ন করতে গিয়ে সনাতনরা দেখে তারা আশেপাশে কোথাও নেই! কখন যেন উধাও হয়ে গেছে!
ক্রমশ…